রবিবার, ১৫ জুন, ২০২৫
কাদেরী টাইমস কলকাতা মেদিনীপুর সাহিত্য ইসলামিক রাজ্য দেশ আন্তর্জাতিক খেলা সম্পাদকীয় বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য, ভ্রমণ ই – পেপার ও ম্যাগাজিন
ইসলামিক

ঐতিহাসিক আল গাদীরেখুম ও মৌওলা আলী (আঃ)

ইসলামিক ডেস্ক :

রাসূলে পাক সাঃ গাদীরেখুমে হজরত আলী ইবনে আবু তালিব (আঃ)কে সোয়া লক্ষাধিক হজ্ব ফেরৎ হাজী সাহাবাগণের সম্মুখে ঘোষণা দেন “আমি যার মৌওলা আলীও তার মৌওলা”(বোখারী শরীফ, ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠাঃ ২৮০; তিরমিজি শরীফ ৫:৬৩৩)
সেই ১৮ই জিলহজ্জের ‌ইসলামিক ১০হিজরী সনের এই বাক্যটা ছোট কোন বাক্য ছিলনা বরং এটি ছিলো আলী আঃ ও তার পবিত্র পরিবারের ইসলামের প্রতি কৃতজ্ঞতা ত্যাগ ও ভালোবাসার রূপরেখা। দীর্ঘ ভূমিকার পর আহলে বাইত পাকের গুরুত্ব এবং মর্যাদা তাদের অনুসরণের প্রয়োজনীয়তা বিস্তারিত আলোচনা করার পর মৌওলা আলী কাররামুল্লাহু ওয়াযহাদুর হাত তুলে ধরে এ ঘোষণা দিয়েছিলেন রাসূলে পাক সাঃ। আমি যার যার মাওলা, এই আলীও তার তার মাওলা।

বিস্তারিত আলোচনা :
হিজরী দশম সনে। রাসূল (সাঃ) বিদায়ী হজ্জ্ব সম্পন্ন করেছেন। এ নশ্বরপৃথিবী থেকে শেষ বিদায়ের কিছু মাস আগে। প্রথম থেকে তিনি ঘোষনা দিয়েছিলেন এ বৎসর তিনি শেষ হজ্জ্ব সম্পন্ন করবেন। তাই চতুর্দিক থেকে নবীর সাথে হজ্জ্বে অংশগ্রহনের জন্যে অসংখ্য হাজীর সমাগম হয়েছিল। এ বৎসর তিনি এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষন দান করেন যা“বিদায় হজ্জ্বের ভাষন”নামে ইতিহাসে প্রসিদ্ধ হয়ে আছে।হজ্জ্ব সমাপ্ত করে তিনি সহাবাদেরকে সাথে নিয়ে মদীনা অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। প্রচন্ড গরম পথিমধ্যে ‘গ্বাদীরে খুম’ নামক চৌরাস্তায় এসে তিনি থেমে যান। এখানেই ঘটে সেই ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ গাদীরে খুমের ঘটনা। (শিয়া সুন্নী নির্বিশেষে সকল ঐতিহাসিক ও হাদীস বিশারদ এ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে তাদের স্ব স্ব গ্রন্থে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন)। নবী সাঃ বললেন যারা এখনও পিছে পড়ে আছে তাদের জন্যে অপেক্ষা করতে। যারা সিরিয়া ও ইরাক অভিমুখে এ চৌরাস্তা থেকে রওয়ানা হয়ে গেছেন তাদেরকে এ স্থানে ফিরে আসার নির্দেশ দিলেন। উত্তপ্ত বালুকাময় পথ ঘাট লোকে লোকারন্য হয়ে গেল কিছুক্ষনের মধ্যেই। নবী (সা.)- এর জন্যে উচু আসন প্রস্তুত করা হল। আসনের উপর শামিয়ানা টাঙানো হল। আসনটি এমনভাবে উঁচু করে নির্মান করা হলো যেন বহু দূর থেকেও সকলে সুন্দরভাবে নবী করিম (সা.)-কে দেখতে পায়। এমন কী গুরুত্বপূর্ণ বিষয়? যার জন্যে নবী (সা.) আসহাব ও হাজীদের কষ্ট দিবেন? গাদীরে খুমে অবস্থান এবং ভাষন দেওয়ার জন্যে আসন তৈরি করার যে কারন নিহিত আছে তা হলো অব্যবহিত পূর্বে অবতীর্ণ হওয়া নিম্ন আয়াতঃ
অর্থাৎঃ “হে রাসূল! তোমার রবের নিকট থেকে যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তা পৌঁছিয়ে দাও। আর যদি এ কাজ করতে সক্ষম না হও তাহলে রেসালাতের দাওয়াত-ই পৌঁছাতে পারলে না। আল্লাহ মানুষের অনিষ্ট থেকে তোমাকে রক্ষা করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ কাফের জনগোষ্ঠীকে হেদায়েত করবেন না।” (সূরা আল মায়েদা, সূরা নং ৫, আয়াত নং ৬৭)।
উপরোল্লিখিত আয়াতটিতে রাসূল (সা.)-কে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ আয়াতটি অবতীর্ণ করেছেন। নিশ্চয়ই এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা শুধুমাত্র তিনি নবীকেই অবগত করিয়েছেন। আর তা এক্ষনে মানুষের সম্মুখে পেশ করতে হবে। এমন কী অবতীর্ণ করা হয়েছে যা এভাবে ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ব্যক্ত করতে হবে? সূরা মায়েদা হচ্ছে নবী (সা.)- এর উপর অবতীর্ণ হওয়া সর্বশেষ সূরা। এ সূরাটি নবীর শেষ জীবনে নাযিল হয়েছে। ইতিপূর্বে তৌহীদ, শরিয়ত, রেসালাত, ক্বিয়ামত, নামাজ, রোজা, হজ্জ্ব, যাকাত ইত্যদি সব বিষয়ে আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিল। এখন মহান আল্লাহ তিঁনাকে এ আয়াতে হুশিয়ারী উচ্চারণ করে দিচ্ছেন, যদি এ কাজটি সম্পন্ন করা না হয় তাহলে রেসালাতের কোন কিছুই পৌঁছানো হলো না। হ্যাঁ, এটা এমন একটা কাজ যার ফলে রেসালাত পরিপূর্ণ হবে। আর তাই, আল্লাহ রাসূলকে অভয় দিয়ে বলছেন, “আল্লাহ তোমাকে মানুষের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করবেন।” মূলতঃ একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘোষনার জন্যেই প্রিয় নবী (সা.) সবাইকে গ্বদীরে খুমে সমবেত হতে বলেছেন। মহানবী (সা.) তাঁর আসন অলংকৃত করেছেন। রাসূলে পাক সাঃ তিনি তাঁর দীর্ঘ ভাষণের এক পর্যায়ে বলেনঃ

“হে মানব মন্ডলী। আমি কি সকল মু’মিনদের চেয়ে সর্বোত্তম নেতা নই ?…
তোমরা কি জানো না আমি প্রতিটি মু’মিনের প্রাণের চেয়েও প্রিয় নেতা….?
তখন সকলে সমস্বরে বলে উঠলো, “ জি ইয়া রাসূলুল্লাহ”
অতঃপর তাঁর পার্শ্বে উপবিষ্ট হযরত আলী ইবনে আবি তালিবের হাত সকলের সম্মুখে উঁচু করে তুলে ধরলেন। ঐতিহাসিকগণ বলেন, নবী (সা.), হযরত আলী ইবনে আবি তালিবের হাত এমনভাবে উঁচুতে তুলে ধরেছিলেন যে, তাঁদের উভয়ের বাহুমূলদ্বয় সবাই দেখতে পেয়েছেন।
অতঃপর মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বললেনঃ
“হে লোক সকল! আল্লাহ আমার প্রভু ও নেতা, আর আমি তোমাদের নেতা বা মাওলা। সুতরাং আমি যার নেতা ও অভিভাবক আলীও তার নেতা ও অভিভাবক। হে আল্লাহ! যে আলীকে ভালবাসে তুমি তাকে ভালবাস, যে আলীর সাথে শত্রুতা পোষন করে তুমি তাকে শত্রু গণ্য করো। আর যে তাকে সাহায্য করে তুমি তাকে সহায়তা দান করো এবং যে তাকে ত্যাগ করে তুমি তাকে পরিত্যাগ করো…..।
পরক্ষনই অবতীর্ণ হল নিম্নোক্ত আয়াতটিঃ
আজকে তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের উপরআমার নেয়ামতকে সম্পূর্ণ করলাম আর আমি দ্বীন ইসলামের ব্যাপারে তোমাদের উপর সন্তুষ্ট হলাম।”(সূরা মায়েদা, আয়াত নং ৩)
সাথে সাথে রাসূল (সা.) বললেনঃ
“আল্লাহু আকবার, দ্বীন পরিপূর্ণতা লাভ করেছে এবং নেয়ামত সম্পূর্ণরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। আমার রব আমার রেসালাত ও আলীর বেলায়েতের ব্যাপারে সন্তুষ্ট হয়েছেন।” অতঃপর সকলে পর্যায়ক্রমে ইমাম আলীকে অভিনন্দন জ্ঞাপন করতে লাগলেন।

ইত্যবসরে হযরত ওমর রাঃ বলে উঠলেনঃ
“শুভ হোক আপনার জন্যে, হে আলী বিন আবি তালিব। আজ থেকে আপনি সকল মুমিন নর-নারীদের নেতা হিসেবে পরিগনিত হলেন।”
অন্য বর্ণনায় এরূপ আছে যে, হযরত ওমর বলেছেন,
“মারহাবা, মারহাবা! হে আবু তালিবের পুত্র।” গাদীরে খুমের এ ঐতিহাসিক ঘটনাটি ১১০ জন সাহাবী, ১০ জন সর্বজন শ্রদ্ধেয় তাবেয়ী এবং ৩৬০ জন বিশিষ্ট ওলামা ও ইসলামী চিন্তাবিদ সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। এ ঘটনাটির বর্ণনা সর্বস্তরের ইতিহাসবেত্তাগণ তাদের স্ব স্ব কিতাবে সহি হাদীস হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। ঐতিহাসিক ইয়াক্বুবী এটাকে সুস্পষ্ট সহি হাদীস হিসাবে উল্লেখ করেছেন।
তথ্যসূত্রঃ
মুসতাদরক আল্ হাকেম, খন্ড ৩, পৃঃ নং ১০৯।
তারিখে ইবনে কাসির, খন্ড ৪, পৃঃ নং ২৮১, ৩৬৮, ৩৭০, খন্ড ৫, পৃঃ নং ২০৯।
মুসনাদ আহমাদ, খন্ড ১, পৃঃ নং ১১৮, ১১৯।
সুনানে ইবনে মাজাহ, খন্ড ১, পৃঃ নং ৪৩, হাদীস নং ১১৬।
তারিখ ইয়াক্বুবী, খন্ড ২, পৃঃ নং ৪৩।
তাবাক্বাত আল্ কোবরা, খন্ড ২, অংশ ২, পৃঃ নং ৫৭।
সিরাহ আল্ হালবিয়্যা, খন্ড ৩, পৃঃ নং ৩৯০।
তারিখে তাবারী, খন্ড ২, পৃঃ নং ৪২৯।
জমায়েয যাওয়ায়েদ, লেখকঃ হেইসামী আশ শাফেঈ, খন্ড ৯, পৃঃ নং ১৬৪।
আস সাওয়ায়িক্বুল মুহরেক্বা, পৃঃ নং ২৫।
তারিখে দামেশক, খন্ড ২, পৃঃ নং ৪৫।
উসুল আল্ মুহিম্মা, পৃঃ নং ২৪।
সহিহ মুসলিম, খন্ড ২, পৃঃ নং ৩৬২।
আনসাব ফাল আশরাফ, খন্ড ২, পৃঃ নং ৩১৫।
খাসায়িস আমিরুল মু’মিনিন লি নিসাঈ, পৃঃ নং ৩৫, ৯৩ । কানযুল উম্মাল, খন্ড ৪, পৃঃ নং ৫৩, হাদিস নং ১০৯২ ।সমস্ত প্রশংসা সেই মহান আল্লাহ্ তায়ালা জন্য, যিনি হুজুর পাক পাঞ্জাতন ত্ত আমীরুল মোমিনীন মৌওলা আলী আঃ এর সকল ইমাম (আঃ)-এর “ভালোবাসা”কে আমাদের মনের মধ্যে দিয়েছেন। আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেছেন, “আমি জ্ঞানের শহর এবং আলী তার দরজা।
[আল মুস্তাদরাক, খন্ড-৪, পৃষ্ঠা-৯৬, ৪৬৯৩]। মহান রাব্বুল আলামীন এই জ্ঞানের দরজার ওসিলায় আমাদের জ্ঞানকেও বিকশিত করুন ।

SHARE

Related posts

খলিল ও হাবিবের কুরবানী

Qadri Times

৬০ হিজরীর ৯ই জিলহজ্জ কুফায় শহীদ হন হযরত মুসলিম ইবনে আকীল (আ.)-র শাহাদাত স্বরনে

Qadri Times

নাযাতের বিজড় রাত্রীগুলিই কি শুধু শব এ ক্বদর ?

Qadri Times

Leave a Comment

হোম
ট্রেন্ডিং
ভিডিও
ই-পেপার
যোগাযোগ