এস এম মঈনুল হকঃ
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মা আমিনার গর্ভ হতে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন রবিউল আউয়াল চাঁদের ১২ই তারিখে ফাল্গুন মাসের সোমবারের শূবহ্ সাদীকে। যে সময়টা ছিল রাত্রীর শেষ এবং দিনে শুরু। তার কারণ ছিল একটাই। সেটা হল, আল্লাহর নিকট রাত্রী এবং দিন আরজ্ করেছিল যেন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কে তাদের নিজেদের সময়ের মধ্যে পাঠানো হয়। মহান আল্লাহ্ তাঁর হাবিবুল্লাহকে উক্ত সময়ে এই কারণে পাঠালেন যেন রাত্রী বা দিন রাসুলুল্লাহ (সাঃ)কে পাওয়ার মানসে গর্বে গরীয়ান বা মহীয়ান হয়ে না ওঠে। রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের এর ৪০ বছর বয়সে নবুওয়াত প্রকাশিত হওয়ার পর তাঁর চাচা হযরত আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু ইসলাম ধর্মের অনুসারী হওয়ার পর একদিন রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন যে আমি জানতাম আপনি অন্যের থেকে ব্যতিক্রমী হবেন। রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- কেন তুমি এরূপ ধারণা পোষণ করেছিলে? হযরত আব্বাস বললেন- জন্মের পর যখন আপনাকে দোলনায় রাখা হয়েছিল তখন আপনার মুখ থেকে একটা বাক্য আমি শূনেছিলাম। কচি মুখে আপনি বলছিলেন- রাব্বি হাবলি উম্মাতি। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- তুমি ঠিকই শুনেছিলে। সেই কথাটার একটা ব্যাখ্যা দেওয়া যাক। হাবলি অর্থাৎ হেবা করা যার ইংরেজি রূপ হল রেজিস্ট্রেশন। অর্থাৎ সেদিন রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোজ কিয়ামতের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত যত উম্মত পৃথিবীতে আসবেন সমস্ত উম্মাতের নাম তাঁর নিজের খাতায় রেজিস্ট্রেশনের ফরিয়াদ তিনি আল্লাহর নিকট করেছিলেন এবং মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর এই দোস্তের ফরিয়াদ কবুল করেছিলেন। সুতরাং রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষরূপে জন্ম নিলেও তাঁর আগমন হয়েছিল নবী রূপে। মহান আল্লাহ্ তাঁর বন্ধুর নবুওয়াত প্রকাশ করেছেন রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ ) এর ৪০ বছর বয়সে। এই নিয়ে মনে কোন সংশয় না থাকাই উচিত। তারপর আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বললেন সেদিন আমি আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করেছিলাম। আপনার ডান হাতের তর্জনী আপনি নাড়াচ্ছিলেন। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আপনার আঙ্গুলের ইশারায় চাঁদ এদিক ওদিক নড়াচড়া করছে। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি ঠিকই দেখেছিলে। আমি যখন একাকীত্ব বোধ করছিলাম তখন আকাশের চাঁদ আমার সঙ্গে খেলা করার জন্য বন্ধুত্ব করেছিল। তখন আমি চাঁদের সঙ্গে খেলা করছিলাম। এই কারণে আবু জেহেল যখন আমাকে চাঁদকে দ্বিখণ্ডিত করতে বলল, আমি আমার বন্ধু চাঁদকে দ্বিখন্ডিত হতে বলেছিলাম এবং চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল। তুমি কি জানো, এই পৃথিবী সৃষ্টির রহস্য কি? আব্বাস রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ , আপনিই এ ব্যাপারে সব থেকে বেশি জ্ঞাত। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, শোনো তাহলে- যখন আল্লাহ্ এবং আল্লাহর আরশ্ ছাড়া কিছুই ছিল না তখন মহান আল্লাহ একখণ্ড নূরকে উপরের দিকে ছেড়ে দিলেন। নূর খন্ডটি যখন নিচের দিকে নামতে থাকলো তখন মহান আল্লাহ বললেন মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ্(সঃ)। নুর খন্ডটি উপরের দিকে উঠতে থাকলো এবং বলল, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ। বহু বছর যাবৎ মহান আল্লাহ্ তায়লা এই নূরের সঙ্গে খেলা করেছিলেন। তারপর সপ্তম জমিন ও সপ্তম আসমান সৃষ্টি করার জন্য ১৮ হাজার মাখলুকাতের সর্বপ্রথম মানুষ সৃষ্টি করলেন আদম আলাইহি ওয়াসাল্লামকে। মাটির মানুষ আদমকে তৈরী করার পর ওই নূরের সামান্য অংশ দিয়ে তাঁর দেহে প্রাণের সঞ্চার করলেন মহান রব্বুল ইজ্জত এবং ওই নূরেরই কিয়ৎ অংশ দ্বারা তিনি এই আঠারো হাজার মাখলুকাতের সমস্ত জীবজন্তুকে সৃষ্টি করলেন। আঠারো হাজার মখলুকাত সৃষ্টির প্রথম কথাটি ছিল মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ যা মহান আল্লাহর মুখনিঃসৃত বাণী এবং দ্বিতীয় কথাটি ছিল লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ যা মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখনিঃসৃত বাণী। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াত প্রকাশিত হওয়ার পর মহান আল্লাহতায়ালার মহা ইচ্ছা ছিল তাঁর প্রিয় হাবিব এর সঙ্গে ‘মেরাজ’ করা।২৭শে রজব রাত্রীটাকে বেছে নিয়ে মহান আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় ফেরেশতা জিব্রাইল আলাহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে বেহেশতী যানবাহন বোররাকের সাহায্যে সাক্ষাতের প্রার্থী হলেন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে মেরাজ করার জন্য।মসজিদুল আকসায় ৭০ হাজার ফেরেশতাদের নামাজের ইমামতী করে হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) বোররাক যানের সাহায্যে জিব্রাইল ( আঃ )এর সঙ্গে সিদরাতুল মুনতাহায় গিয়ে পৌঁছলেন। বিনম্রভাবে জিব্রাইল আলাইহিস সাল্লাম বললেন, ইয়া রসুলুল্লাহ্ আপনি এখানে কিয়ৎক্ষণ দণ্ডায়মান হোন। এই পর্যন্ত আমার আসার সীমানা নির্ধারিত। এটা আমার জন্য একটা ডেঞ্জারাস বর্ডার। চুল পরিমান ক্রস করলে আমার বোররাক সহ আমি আল্লাহর নূরের তাজাল্লিতে পূড়ে ছারখার হয়ে যাব। এইখান থেকে আমি লওহে মাহফুজের দিকে তাকিয়ে থেকে আল্লাহর বাণী কোরআন শুনি এবং তা আপনার উপর নাযিল করে আসি। তারপর বোররাক নিয়ে জিব্রাইল আলাইহি ওয়া সাল্লাম চলে গেলে কিছুক্ষণ পর ‘রফরফ’ নামক এক যানের সাহায্যে রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরশে মোয়াল্লার কাছাকাছি পৌঁছলেন। আল্লাহর নূরের তৈরি স্পেশাল ফেরেস্তারা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ‘গার্ড অফ অনার’ দেন এই বলে- ইয়া নাবী সালাম আলাইকা, ইয়া রাসূল সালাম আলাইকা……। তারপর মহান আল্লাহ্ তাঁর প্রিয় হাবিবকে আরশে মোয়াল্লার উপর উঠতে বললে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছুটা ইতস্ততঃ বোধ করতে লাগলেন। তারপর ধীরে ধীরে আরশে মোয়াল্লায় উঠলে মহান আল্লাহ্ তাঁর হাবিবকে বললেন, ইয়া হাবিব, আপনি দেখে নিন এই আরশে মোয়াল্লায় আপনার কতখানি অংশ নির্ধারিত আছে। এটাই ছিল রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে মহান আল্লাহতায়লার মেরাজের উদ্দেশ্য। কেন রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়াবী শিক্ষা করেননি? এর কারণ হল, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি দুনিয়াবী শিক্ষা করতেন তাহলে, একজন শিক্ষাগুরুর দরকার হত। তাহলে, কিছুটা হলেও ঐ শিক্ষাগুরুর মর্যাদা রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের থেকে উন্নত হত। মহান আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর সৃষ্টির সর্বোত্তম সৃষ্টি হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর থেকে অন্য কারো মর্যাদা বেশি হোক তিনি যা চাননি। মহান আল্লাহ্ পার্থিব ও অপার্থিব সমস্ত শিক্ষা দিয়ে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দুনিয়ায় প্রেরণ করেছিলেন। মহান আল্লাহ্ নিজেই হযরত মুহাম্মদ (সাঃ )এর মহান শিক্ষক ছিলেন। তাই দুনিয়াবী শিক্ষার তাঁর আর কোনও প্রয়োজনই হয়নি। একদিন রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে একটা বিছায় কামড়ে দিলে তিনি মা আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা কে বললেন লবণ জল গরম করে ক্ষতস্থানে ঢালতে। তিনি তাই করলেন এবং জল ঢালতে ঢালতে লক্ষ্য করলেন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দোয়া পাঠ করছেন। মা আয়েশা বললেন ইয়া রাসুলুল্লাহ্ আপনার দোয়াই তো যথেষ্ট। লবণ জল লাগানোর দরকার কি সত্যিই ছিল। হযরত মুহাম্মদ (সঃ) বললেন, আমি যা করছি তা আমার উম্মতের জন্য করছি। অনেক সময় সকল উম্মতের দোয়া আল্লাহ্ কবুল করবেন না। তাই দোয়ার সঙ্গে দাওয়ারও প্রয়োজন। পরবর্তীতে বিজ্ঞানীরা এই হাদিসটির উপর গবেষণা করে জানতে পারেন যে, লবণে সোডিয়াম ক্লোরাইড আছে যা পেইন কিলার হিসাবে কাজ করে। বিজ্ঞানীরা অবাক হয়ে বলেন ১৪০০ বছর আগের হযরত মুহাম্মদই শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী। এরকম অনেক ঘটনা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবনে ঘটেছিল যা এই সীমিত লেখার মধ্যে লিপিবদ্ধ করা সম্ভব নয়। আল কুরআন এর মত শ্রেষ্ঠতম মহাগ্রন্থ আর পৃথিবীতে প্রকাশ হয়নি তার বহু প্রমাণ বিজ্ঞানীরা দিয়েছেন।আঠেরো হাজার মাখলুকাতে যত প্রশ্ন আছে তার সমস্ত উত্তর আল কোরআনের মধ্যে লিপিবদ্ধ আছে যা পৃথিবীর আর কোনও গ্রন্থে নেই। আর এই আল কুরআনই ছিল মোহাম্মদ (সাঃ) এর চরিত্র। এই জন্যই মহান আল্লাহ্ তায়ালার সর্বোত্তম সৃষ্টি এবং সর্বোত্তম চরিত্র হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই বিশ্ব মানবতার মূর্ত প্রতীক। এই লেখনী পাঠকের মনে কোনো সংশয়ের কারণ হলে তার প্রমাণ দিতে বাধ্য থাকিব।