রবিবার, ১৫ জুন, ২০২৫
কাদেরী টাইমস কলকাতা মেদিনীপুর সাহিত্য ইসলামিক রাজ্য দেশ আন্তর্জাতিক খেলা সম্পাদকীয় বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য, ভ্রমণ ই – পেপার ও ম্যাগাজিন
ইসলামিক

আবে জমজম: সৃষ্টির ইতিহাস ও বসতি স্থাপন

এস এম মঈনুল হক : ফুলসহরী, মুর্শিদাবাদ

ভূমিকা:
ইসলামী ইতিহাসে ‘আবে জমজম’ বা ‘জমজম কূপ’ একটি অলৌকিক ও পবিত্র নিদর্শন। এটি কেবল একটি পানির উৎস নয়; এটি এক বিশাল ইতিহাস, ঈমান, আত্মত্যাগ ও আল্লাহর রহমতের প্রতীক। মক্কার হারাম শরীফে কা’বা শরীফের কাছাকাছি অবস্থিত এই কূপটি হাজার হাজার বছর ধরে মুসলমানদের তৃষ্ণা নিবারণ করছে এবং হজ ও উমরাহ পালনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। জমজম কূপের উৎপত্তি মূলত হযরত ইসমাইল (আঃ) ও হযরত হাজেরা (আঃ) এর ত্যাগ ও ধৈর্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর আদেশ :
হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ছিলেন একজন খালিলুল্লাহ – আল্লাহর পরম বন্ধু। তিনি আল্লাহর নির্দেশে তাঁর স্ত্রী হাজেরা ও নবজাতক সন্তান ইসমাইল (আঃ)-কে নিয়ে মক্কার নির্জন, অনুর্বর, গরম ও পানি-শূন্য উপত্যকায় রেখে যান। সেই সময়ে সেখানে কোনো বসতি ছিল না। আল্লাহর নির্দেশে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) স্ত্রী ও সন্তানকে সেখানে রেখে দোয়া করেন—
হে আমাদের প্রতিপালক! আমি আমার এক বংশধরকে বসবাস করালাম আপনার পবিত্র ঘরের ( কাবা) কাছে এক অনুর্বর উপত্যকায়।”
(সূরা ইব্রাহিম, ১৪:৩৭)
হাজেরা (আঃ) জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আপনি আমাদের এখানে রেখে যাচ্ছেন কেন?” হযরত ইব্রাহিম (আঃ) কোনো উত্তর না দিয়ে ফিরে যেতে থাকেন। অবশেষে হাজেরা (আঃ) বলেন, “আল্লাহ কি আপনাকে এ কাজ করতে বলেছেন?” ইব্রাহিম (আঃ) সম্মতিসূচক মাথা নাড়েন। তখন হাজেরা (আঃ) বলেছিলেন, “তাহলে নিশ্চয়ই তিনি আমাদের নষ্ট হতে দেবেন না।”
আল্লাহর পরীক্ষায় মা ও সন্তানের ধৈর্য:
মক্কার সেই সময়কার পরিবেশ ছিল চরম প্রতিকূল। খাদ্য, পানি কিছুই ছিল না। কিছু শুকনো খাবার ও পানি নিয়ে হাজেরা (আঃ) ও তাঁর দুধের শিশু ইসমাইল (আঃ) সেখানে অবস্থান করছিলেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে খাবার ও পানি শেষ হয়ে যায়। ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় শিশুটি কাঁদতে শুরু করে।
হযরত হাজেরা (আঃ) তখন আশেপাশে পানি খুঁজতে শুরু করেন। তিনি সাহসিকতার সাথে দুই পাহাড়—সাফা ও মারওয়ার মাঝে সাতবার দৌড়াদৌড়ি করেন। এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড় পর্যন্ত দৌড়ানো ছিল তার মায়ের ভালোবাসা ও আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুলের অনন্য নজির।
জমজম কূপের সৃষ্টির অলৌকিকতা:
হযরত হাজেরা (আঃ) যখন মারওয়ার উপর দাঁড়িয়ে আশেপাশে দেখছিলেন, তখন তিনি একটি শব্দ শুনতে পান। তিনি ফিরে এসে দেখতে পান, ইসমাইল (আঃ)-এর পায়ের নিচে বা হাত দিয়ে ঘষার জায়গা থেকে পানি বের হচ্ছে। আল্লাহ তা’আলা জিবরাইল (আঃ)-এর মাধ্যমে সেই পানির উৎস প্রকাশ করেন। এটি ছিল এক অলৌকিক ঘটনা।
জিবরাইল (আঃ) এসে জমিনে আঘাত করলে পানির ঝরনা বের হয়। হাজেরা (আঃ) তাড়াতাড়ি এসে সেই পানি ঘিরে রাখেন ও বলেন, “জমজম”, যার অর্থ “থেমে যাও” বা “থামাও থামাও”। তখন থেকেই এর নাম হয়ে যায় জমজম কূপ।
জমজম কূপ: আশীর্বাদ ও প্রতীক:
এই পানি শুধুই তৃষ্ণা মেটানোর জন্য নয়; এটি বরকতময় ও রোগ নিরাময়কারীও। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন—
জমজমের পানি যেকোনো উদ্দেশে পান করা হয়, তা পূরণ হয়।”
(ইবনু মাজাহ)
আরেক হাদীসে বলা হয়েছে, এটি হলো-
” ভোজনকারীর খাদ্য ও রোগীর আরোগ্য।”
(মুসলিম)
বসতি স্থাপনের সূচনা :
যখন জমজম কূপের পানি স্থায়ীভাবে প্রবাহিত হতে শুরু করল, তখন এ অঞ্চল ধীরে ধীরে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে শুরু করল।
জুরহুম গোত্রের আগমন :
ইয়েমেন থেকে আগত জুরহুম গোত্র একদিন হিজরত করতে করতে মক্কার অঞ্চলে এসে পৌঁছায়। তারা কা’বার পার্শ্ববর্তী এই নতুন পানির উৎস দেখে বিস্মিত হয়। তখন তারা হাজেরা (আঃ)-এর অনুমতি চায় এখানে বসতি স্থাপনের জন্য। হাজেরা (আঃ) দয়ালু মন নিয়ে বলেন, “তোমরা এখানে থাকতে পারো, তবে কূপের মালিকানা আমাদের থাকবে।”
এইভাবেই জমজম কূপকে কেন্দ্র করে মক্কা নগরীর প্রাথমিক ভিত্তি গড়ে ওঠে।
ইসমাইল (আঃ) এর বড় হয়ে ওঠা ও বিবাহ:
ইসমাইল (আঃ) বড় হতে থাকেন এই অঞ্চলে। জুরহুম গোত্রের মধ্যেই তিনি বিবাহ করেন এবং আরবদের মধ্যেই মিশে যান। তিনি শিকারি, যোদ্ধা ও কৌশলী মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠেন। আরব ইতিহাসে তাকে ‘আরব মুস্তারিবা’ (আরবীয়কৃত ব্যক্তি) বলা হয়। তিনি পরবর্তীতে কাবা নির্মাণেও পিতার সাথে অংশগ্রহণ করেন।
কাবা নির্মাণ:
ইসমাইল (আঃ) যখন বড় হয়ে ওঠেন, তখন হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ফেরত আসেন। তারা একত্রে কা’বা নির্মাণের কাজ শুরু করেন। জমজম কূপ তখনই কা’বার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
“যখন ইব্রাহিম ও ইসমাইল কাবার ভিত্তি স্থাপন করছিলেন, তখন তাঁরা বলেছিলেন: হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের পক্ষ থেকে এটি গ্রহন করে নাও।”
(সূরা বাকারা: ১২৭)
জমজম কূপের হারিয়ে যাওয়া ও পুনরাবিষ্কার
সময়ের পরিক্রমায় মক্কা নগরীতে অনেক পরিবর্তন আসে। জুরহুম গোত্র ক্ষমতা হারায় এবং মক্কার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় অন্যান্য গোত্রের হাতে। তখন কিছু লোক জমজম কূপটি মাটি ও ধ্বংসাবশেষ দিয়ে বন্ধ করে দেয়, যাতে তার চিহ্নও হারিয়ে যায়।
কয়েক শতাব্দী পরে, হযরত আবদুল মুত্তালিব—যিনি ছিলেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর দাদা—একটি স্বপ্নের মাধ্যমে জমজম কূপের অবস্থান জানতে পারেন এবং মাটি খুঁড়ে এটি পুনরুদ্ধার করেন। এই সময় তিনি অনেক বাধা-বিপত্তির মুখোমুখি হন, তবে আল্লাহর সাহায্যে কূপটি পুনরায় আবিষ্কৃত হয় এবং তা আবারো সক্রিয় হয়ে ওঠে।
ইসলামের যুগে জমজমের গুরুত্ব:
হযরত মুহাম্মদ (সঃ) জমজম কূপ থেকে পানি পান করেছেন এবং তাঁর সাহাবীদেরও পানি পানে উৎসাহ দিয়েছেন। হজ ও উমরাহ পালনের সময় জমজম পানির গুরুত্ব অপরিসীম। হাজীরাও ইসমাইলের কাহিনী স্মরণ করে হাজেরা (আঃ)-এর দৌড়ানোকে কেন্দ্র করে সাফা-মারওয়া সাঈ আজও হজের অংশ হিসেবে পালন করা হয়।
বর্তমানে জমজম কূপ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সংরক্ষণ ও বিতরণ করা হয়। প্রতি বছর লাখ লাখ হাজী জমজম পানির স্বাদ গ্রহণ করেন এবং দেশে ফিরবার সময়ও সঙ্গে নিয়ে যান।
জমজম কূপের গভীরতা প্রায় ৩০ মিটার, এবং এটি এখনো প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১১-১৮ লিটার পানি সরবরাহ করে। এটি কোনো নদী বা হ্রদের সাথে সংযুক্ত নয়, বরং এটি এক আল্লাহর রহমতে জন্ম নেয়া ভূগর্ভস্থ উৎস।
উপসংহার:
আবে জমজম শুধুমাত্র একটি প্রাকৃতিক কূপ নয়; এটি ঈমান, ত্যাগ ও আল্লাহর উপর বিশ্বাসের জীবন্ত প্রতীক। হযরত হাজেরা (আঃ)-এর আত্মত্যাগ, ইসমাইল (আঃ)-এর ধৈর্য এবং ইব্রাহিম (আঃ)-এর আনুগত্য মিলেই এই অলৌকিক কূপের সৃষ্টি। আজও মুসলিম বিশ্বে জমজম পানি বিশুদ্ধতার প্রতীক, ঈমানের স্মারক এবং আল্লাহর এক জ্বলন্ত নিদর্শন হিসেবে সম্মান।

SHARE

Related posts

নাযাতের বিজড় রাত্রীগুলিই কি শুধু শব এ ক্বদর ?

Qadri Times

গাদীরে খুমের বার্তা

Qadri Times

মহানবী (স:) এর মেরাজ মোবারক

Qadri Times

Leave a Comment

হোম
ট্রেন্ডিং
ভিডিও
ই-পেপার
যোগাযোগ