বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ, ২০২৫
কাদেরী টাইমস কলকাতা মেদিনীপুর সাহিত্য ইসলামিক রাজ্য দেশ আন্তর্জাতিক খেলা সম্পাদকীয় বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য, ভ্রমণ ই – পেপার ও ম্যাগাজিন
সম্পাদকীয়

ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা অর্জনের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত

ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা অর্জনের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত

মজিবুর রহমান, প্রধানশিক্ষক, কাবিলপুর হাইস্কুল কাবিলপুর, মুর্শিদাবাদ

মানবসভ্যতার বিকাশে ভাষা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ভাষা মনের ভাব প্রকাশের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। প্রত্যেকেই জন্মসূত্রে একটি মাতৃভাষা লাভ করে। দেশ ত্যাগ করা যায়, ধর্মান্তরিত হওয়া যায় কিন্তু মাতৃভাষা পরিবর্তন করা যায় না। মাতৃভাষার এমনই মহিমা। একজন শিক্ষার্থী বিদ্যার্জনের অঙ্গ হিসেবে মাতৃভাষা ছাড়াও এক বা একাধিক ভাষা শেখে। কিন্তু মাতৃভাষার সঙ্গে সে সবসময়ই একটি বাড়তি নৈকট্য অনুভব করে। মায়ের সঙ্গে সন্তানের যেমন ‘নাড়ির টান’ মাতৃভাষার সঙ্গে মানুষের তেমনি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় ‘মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ স্বরূপ’। ভাষাবিদদের মতে দশ হাজার বছর আগে বিশ্বে জনসংখ্যা ছিল দশ লাখ আর ভাষা ছিল দশ হাজার। মানুষের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে আটশো কোটি হয়েছে কিন্তু ভাষার সংখ্যা কমতে কমতে হয়েছে ছয় হাজার। ভবিষ্যতে মানুষের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে কিন্তু ভাষার সংখ্যা আরও হ্রাস পাবে। যেসব ভাষার লিপি নেই সেগুলো ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হবে। ভাষাভাষী জনসংখ্যার নিরিখে বিশ্বের প্রধান দশটি ভাষা হল চিনা, ইংরেজি, স্প্যানিশ, আরবি, রুশ, ফরাসি, হিন্দি, বাংলা পর্তুগিজ ও জাপানি। বিশ্বের অর্ধেকের বেশি মানুষ এই দশটি ভাষাতেই কথা বলে। ভারতীয় উপমহাদেশে একসময় হাজার খানেকের বেশি ভাষা ছিল। এখন সংখ্যাটা তিনশোর মতো। অন্তত দশ হাজার মানুষ কথা বলে এমন ভাষার সংখ্যা দেড়শোর কম। ভারতের সংবিধানে অষ্টম তফশিলে অন্তর্ভুক্ত ভাষার সংখ্যা বাইশ- (১) অসমীয়া, (২) বাংলা, (৩) গুজরাটি, (৪) হিন্দি, (৫) কন্নড়, (৬) কাশ্মীরি, (৭) মালয়ালম, (৮) মারাঠি, (৯) ওড়িয়া, (১০) পাঞ্জাবি, (১১) সংস্কৃত, (১২) তামিল, (১৩) তেলুগু, (১৪) উর্দু, (১৫) কোঙ্কনি, (১৬) মণিপুরী, (১৭) নেপালি, (১৮) সিন্ধি, (১৯) বোড়ো, (২০) ডোগরি, (২১) মৈথিলি ও (২২) সাঁওতালি। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের জনগোষ্ঠীর পরিচয় প্রধানত দেশ, ধর্ম ও ভাষার ভিত্তিতে হয়ে থাকে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের, এক ধর্মের মানুষের সঙ্গে অন্য ধর্মের মানুষের সাংঘাতিক সংঘাতের ঘটনার অভাব নেই। সেই তুলনায় দুটো পৃথক ভাষার জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিবাদ অপেক্ষাকৃত কম। উপমহাদেশে অবশ্য ভাষাকে কেন্দ্র করেই এমন ইতিহাস রচিত হয়েছে যার দৃষ্টান্ত গোটা বিশ্বেই বিরল। এই নজিরবিহীন ও গর্বের ঘটনার সঙ্গে বাংলা ভাষা ও পূর্ববঙ্গের বাঙালিরা ভীষণভাবে জড়িত। বাংলা ভাষার জন্য বাঙালির প্রাণ উৎসর্গকে স্বীকৃতি দিতে বিশ্বের বৃহত্তম শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কো ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়। বেলুচিস্তান, খাইবার পাখতুনখোয়া, সিন্ধু, পাঞ্জাবের পশ্চিমাংশ ও বাংলার পূর্বাংশ নিয়ে গঠিত হয় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র পাকিস্তান। প্রথম চারটি প্রদেশ একত্রে পশ্চিম পাকিস্তান এবং পঞ্চম প্রদেশটি পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে পরিচিত হয়। পাকিস্তানের এই দুই অংশের মধ্যে ব্যবধান ছিল বারোশো মাইল। ধর্ম এক হওয়া ছাড়া ভূপ্রকৃতি সহ অন্যান্য ক্ষেত্রে দুই পাকিস্তানের মধ্যে বিশেষ মিল ছিল না। বরং ভাষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অনৈক্য ছিল অনেক। এজন্য নবগঠিত পাকিস্তানের দুই বাহুর মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার বদলে বিবাদ লাগতে বিলম্ব হয়নি। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণ নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক এই বিবাদের ভিত্তি রচনা করে। সেই সময় পাকিস্তানের প্রধান ভাষা ছিল ছয়টি- বাংলা, বেলুচি, পশতু, সিন্ধি, পাঞ্জাবি ও উর্দু। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল যথাক্রমে মোটামুটি সাড়ে চার কোটি ও আড়াই কোটি। পূর্ব পাকিস্তানের নব্বই শতাংশ এবং সমগ্ৰ পাকিস্তানের ৫৫ শতাংশ মানুষের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। উর্দু ছিল পাঁচ শতাংশ মানুষের মাতৃভাষা এবং এটি কোনো প্রদেশেরই প্রধান ভাষা ছিল না। বাকি চল্লিশ শতাংশ মানুষের মুখের ভাষা ছিল বেলুচি, পশতু, সিন্ধি ও পাঞ্জাবি। নাম দেখেই বোঝা যায় এই ভাষাগুলো ছিল যথাক্রমে বেলুচিস্তান, খাইবার পাখতুনখোয়া, সিন্ধু ও পাঞ্জাবের প্রধান ভাষা।‌ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মুসলমানদের ধর্মীয় ভাষা আরবি। কিন্তু উপমহাদেশে আরবির প্রসার ঘটেনি। বরং উর্দুর চর্চা বৃদ্ধি পেতে দেখা যায়। অভিজাত মুসলমানরা ইংরেজির সঙ্গে উর্দুটাও শিখতেন। এজন্য পাকিস্তানের শাসকশ্রেণী তথা মুসলিম লীগের জাতীয় স্তরের নেতৃবৃন্দের উর্দুর প্রতি একটা অনুরাগ ছিল। তাঁরা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে এক ও একমাত্র উর্দুর কথাই বিবেচনা করেন। এরই অঙ্গ হিসেবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ডাক বিভাগের কাগজপত্রে ইংরেজির সঙ্গে উর্দু জুড়ে দেওয়া হয়। মুদ্রাতেও ইংরেজির সাথে উর্দু লেখার ব্যবস্থা করা হয়। ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। এইভাবে জাতীয় স্তরে পাকিস্তানের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর ভাষা বাংলা সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হতে থাকে। বাংলা ভাষার এই উপেক্ষা ও অসম্মান নিশ্চিতভাবেই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের ব্যথিত করে এবং তাদের মধ্যে গুঞ্জন তৈরি হয়। তারা উপলব্ধি করে যে, বাংলা ভাষা অবদমিত হলে বাঙালির জাতিসত্তাও নতুন রাষ্ট্রে অদূর ভবিষ্যতে সুরক্ষিত থাকার সম্ভাবনা কম। বাংলা ভাষা গুরুত্ব হারালে বাঙালির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার ওপরেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সুতরাং, বাংলা ভাষার প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের বঞ্চনা মেনে নেয়া যায় না। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর গণপরিষদের অধিবেশন শুরু হয় ১৯৪৮ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি। বক্তৃতার ভাষা নির্ধারণ করা হয় ইংরেজি ও উর্দু। কুমিল্লা থেকে জাতীয় কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত গণপরিষদের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলায় বক্তব্য পেশ করতে চাইলে তাঁকে বাধা দেওয়া হয়। উর্দুর সঙ্গে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে তিনি একাধিক অকাট্য যুক্তি তুলে ধরেন। কিন্তু গভর্নর-জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দেন, উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা এবং বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হবে না। মিঃ দত্ত তাঁর সাধ্যমত প্রতিবাদ জানান। এই ঘটনার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ২৬শে ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট পালন করেন। রাজনৈতিক নেতারা ছাত্র আন্দোলনকে সমর্থন জানান। গড়ে ওঠে রাষ্ট্রভাষা সংগ্ৰাম পরিষদ। মিঃ জিন্নাহ মার্চ মাসে পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল জনসভায় ঘোষণা করেন, উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। সমবেত বাংলাভাষী জনতা জিন্নাহ সাহেবের ছবি ছিঁড়ে ও তাঁর সম্মানে তৈরি তোরণ পুড়িয়ে তাঁর বক্তব্যের প্রতিবাদ জানান। কিন্তু মিঃ জিন্নাহ তাঁর ভাষা-ভাবনায় অনড় থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানেও তিনি বলেন, উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পাবে। ছাত্ররা ‘না, না’ ধ্বনি তুলে প্রতিবাদে সরব হন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৪৮ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর মিঃ জিন্নাহ দেহত্যাগ করেন। ১৯৪৯ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চে পাকিস্তান সরকার আরবি হরফে বাংলা লেখার উদ্যোগ নেয়। মার্চ মাসে গঠিত ‘পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি’ বাংলা ভাষা সংস্কারের নামে উর্দু ও আরবি মিশ্রিত খিচুড়ি বাংলা সৃষ্টির ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক: মদনমোহন তর্কালঙ্কার- “সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি/সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি।” সংস্কারকৃত- “ফজরে উঠিয়া আমি দিলে দিলে বলি/সারাদিন আমি যেন নেক হয়ে চলি।” কাজী নজরুল ইসলাম- “সজীব করিব মহাশ্মশান।” সংস্কারকৃত- “সজীব করিব গোরস্থান।” প্রচলিত বাগধারা- ‘দাতা কর্ণ’, ‘বাঘের মাসি’, ‘বিদ্যার দিগগজ’, ‘অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট’ সংস্কারকৃত হয়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ‘দাতা হাতেম’, ‘বাঘের খালা’, ‘এলেমের জাহাজ’, ‘অধিক পীরে মোজেজা নষ্ট’। বাংলা ভাষার মর্যাদা ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষার উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তানে ১১ই মার্চ ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ উদযাপন করা হয়। ২৩শে জুন মুসলিম লীগ ভেঙে গঠিত হয় নতুন রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। দলটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, যুগ্ম সম্পাদক ও সহকারি সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন যথাক্রমে মৌলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান ও খন্দকার মোশতাক আহমেদ। উল্লেখ্য, ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা তথা অসাম্প্রদায়িক চেতনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ১৯৫৫ সালে দলটির নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি অপসারণ করা হয়। ১৯৫২ সালের ২৭শে জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকার পল্টন ময়দানে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। জনসভা থেকে যথারীতি প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়। ৩০শে জানুয়ারি মৌলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে গঠিত হয় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্ৰাম পরিষদ’। সভায় ২১শে ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ ধর্মঘট করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ওই দিন পূর্ব পাকিস্তানের আইন পরিষদের অধিবেশন বসার কথা ছিল। ধর্মঘট ও মিটিং-মিছিল বানচাল করার উদ্দেশ্যে ঢাকা শহরে হঠাৎ ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। কিন্তু সংগ্ৰাম পরিষদ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান নিয়ে ঢাকার রাজপথে মিছিল বের করে। পুলিশ আন্দোলনকারীদের বাধা দেয় এবং কাঁদানে গ্যাস ও গুলি ছোঁড়ে। ২২শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে প্রতিবাদ মিছিলেও পুলিশ গুলি চালায়। অনেকেই শহীদের মৃত্যু বরণ করেন। তবে পুলিশ একাধিক মৃতদেহ লোপাট করে দেয়। এজন্য ভাষা শহিদদের সকলের পরিচয় সুনির্দিষ্ট করে পাওয়া সম্ভব হয়নি। যে পাঁচজন ভাষা শহিদ হিসেবে বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়েছেন তাঁরা হলেন: (১) স্নাতকোত্তর স্তরের ছাত্র আবুল বরকত (জন্ম- ১৬.৬.১৯২৭), (২) কলেজছাত্র রফিক উদ্দিন আহমেদ (জন্ম- ৩০.১০.১৯২৬), (৩) হাইকোর্টের কর্মচারী শফিউর রহমান (জন্ম- ২৪.১.১৯১৮), (৪) ডিরেক্টরেট অব ইন্ডাস্ট্রিজ বিভাগের কর্মচারী আব্দুস সালাম (জন্ম- ২৭.১১.১৯২৫) ও (৫) কৃষিজীবী আব্দুল জাব্বার (জন্ম- ১৩.৮.১৯১৯)। ২৪শে ফেব্রুয়ারি ভাষা শহিদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে একটি শহিদ মিনার নির্মাণ করা হয়। দু’দিনের মধ্যেই পুলিশ ও সরকারি লোকজন সেটি ভেঙে ফেলে। ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। শাসকদল মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে বিরোধীরা একজোট হয়ে লড়াই করার জন্য যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইস্তেহারে ২১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া, ২১শে ফেব্রুয়ারি শহিদ দিবস ও সাধারণ ছুটি ঘোষণা, স্থায়ী শহিদ মিনার স্থাপন, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন প্রভৃতি জনপ্রিয় দাবি ইস্তেহারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। উল্লেখ্য, ২১শে ফেব্রুয়ারির ২১-এর সঙ্গে সঙ্গতি রাখার জন্য ২১ দফা কর্মসূচি স্থির করা হয়। নির্বাচনে ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ মাত্র ন’টিতে জয়লাভ করে। ২১৫টি আসন নিয়ে এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হয়। শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য হন। কিন্তু ৩০শে মে এই সরকারকে বরখাস্ত করে গভর্ণরের শাসন প্রবর্তন করা হয়। ১৯৫৫ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আয়োজিত কর্মসূচি আবারও রক্তাক্ত হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধান গৃহীত হয় এবং বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১৯৫৭-এর নভেম্বর থেকে ‘৫৮-এর মার্চ পর্যন্ত ২১-এর ভাষা শহীদদের স্মৃতিতে মিনার তৈরির কাজ কিছুটা হওয়ার পর দীর্ঘদিন অসমাপ্ত অবস্থায় পড়ে থাকে। ১৯৬২ সালে আবার নির্মাণকার্য শুরু হয়ে ১৯৬৩ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি সমাপ্ত হয়। শহীদ মিনারের মাঝের দীর্ঘতম স্তম্ভটি মায়ের এবং দু’পাশের অপেক্ষাকৃত ছোট স্তম্ভগুলো সন্তানের প্রতীক। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে পাক-ভারত যুদ্ধ হয়। জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় পাক প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মধ্যে তাসখন্দে এক শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৬৬ সালে পাকিস্তানে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবিতে বিরোধী দলগুলো লাহোরে এক সম্মেলনে মিলিত হয়। আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ছ’দফা দাবি পেশ করেন। ইতিহাসের নির্মম পরিহাস হল, যে শহরে একদিন ভারত ভেঙে পাকিস্তান গঠনের বীজ বোনা হয়েছিল সেই শহরেই আজ পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ গঠনের চারাগাছ রোপণ করা হল। ১৯৬৮ সালের প্রথম ভাগে শেখ মুজিব সহ ৩৫ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে ভারতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পাকিস্তানের অখণ্ডতা বিনষ্ট করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগ আনা হয়। আন্দোলনের চাপে পড়ে পাকিস্তানের প্রশাসন ১৯৬৯ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি মামলা প্রত্যাহার করে সকলকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। জেলমুক্তি উপলক্ষে আয়োজিত বিশাল সংবর্ধনা সভায় ছাত্র সংগ্ৰাম পরিষদ শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ আখ্যায় ভূষিত করে।১৯৬৯ সালের নভেম্বর মাসে পূর্ব পাকিস্তান বন্যা সহ ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হয়। প্রচুর মানুষ মারা যায় এবং কয়েক লক্ষ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। কিন্তু দুর্গতদের পাশে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ কিংবা উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীদের দাঁড়াতে দেখা যায়নি। এই ঘটনায় পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী তথা বাঙালিরা পশ্চিম পাকিস্তানীদের সম্পর্কে আরও বিরূপ হয়ে পড়ে। ৫ই ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর (১৮৯২-১৯৬৩) মৃত্যুবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, আজ থেকে পূর্ব পাকিস্তান পরিচিত হবে বাংলাদেশ নামে। এই ঘোষণা বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশের পক্ষে একটি বড় পদক্ষেপ ছিল। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ একাই পায় ১৬৭টি আর পশ্চিম পাকিস্তানের ১৪৪টির মধ্যে পাকিস্তান পিপলস পার্টি পায় ৮৮টি। অর্থাৎ, ৩১৩ আসন বিশিষ্ট জাতীয় পরিষদে ১৬৭টি নিয়ে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। সেই হিসেবে আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবের পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো তা হতে দেননি। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ পূর্ব পাকিস্তানের নেতার নেতৃত্ব মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দেওয়া জনগণের রায়কে উপেক্ষা করতে তাঁরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ থাকেন। এর ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের চূড়ান্ত সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠে। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের সুবিশাল সমাবেশে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, “এবারের সংগ্ৰাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্ৰাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” তিনি সরকারের সঙ্গে সমস্ত রকম অসহযোগিতার ডাক দেন। ২৫শে মার্চ থেকে পাক সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের আন্দোলনকে দমন করতে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, “আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।” এই ঘোষণার অব্যবহিত পরেই তাঁকে বন্দী করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। পাক সামরিক বাহিনী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী রাজাকার, আল বদর ও আল হামাস বাহিনী বাংলাদেশে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে। ব্যাপকভাবে খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট চালানো হয়। শহীদ মিনারকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়। ১১ই এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার বৈদ্যনাথতলা গ্ৰামে ‘স্বাধীন’ বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ও জাতীয় পরিষদের সদস্য আতাউল গনি ওসমানীকে সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত করে গঠিত হয় মুক্তিফৌজ। রাজনৈতিক কর্মী, ছাত্র, কৃষক, শ্রমিকরা মুক্তিফৌজে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সংহতি জানাতে বিদেশের মাটিতে ‘বাংলাদেশ মিশন’ খোলা হয়। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার সর্বপ্রকার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। ডিসেম্বর মাসের শুরুতে পাক বাহিনী ভারতের পশ্চিম সীমান্তে কয়েকটি বিমানঘাঁটিতে আঘাত হানে। ভারতও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে বিলম্ব করেনি। পাকিস্তানের পক্ষে আর লড়াই চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। ১৬ই ডিসেম্বর পাক বাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজী ভারতীয় সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার নিকট আত্মসমর্পণ করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন দেশে পরিণত হয়। বাংলাদেশের এই স্বাধীনতা ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি। কাজেই কালবিলম্ব না করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করা হয়। বাংলায় সংবিধান রচনা করা হয়। শহীদ মিনার পুনর্নির্মাণ করা হয়। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্রপুঞ্জের সদস্য হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বাংলায় বক্তৃতা করেন। ১৯৯৮ সালের জানুয়ারিতে কানাডা প্রবাসী দুই বাংলাদেশী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম ‘বিশ্ব মাতৃভাষা’ সংগঠনের পক্ষ থেকে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রসঙ্ঘের মহাসচিবের কাছে আবেদন জানান। এরপর আবেদনটি ইউনেস্কোতে পাঠানো হয়।১৯৯৯ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও একই প্রস্তাব পেশ করা হয়। প্রস্তাবে বলা হয়, “মাতৃভাষাগুলোর উন্নতি ও বিকাশের অন্যতম কার্যকর পন্থা হল ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ প্রতিষ্ঠা।… ১৯৫২- এর ২১শে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার স্বার্থে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব আত্মত্যাগের স্বীকৃতি এই মাতৃভাষা দিবস।” ভারত সহ ২৭টি দেশ এই প্রস্তাব সমর্থন করে। নভেম্বরে ইউনেস্কো প্রস্তাবটি অনুমোদন করে। ২০০০ সাল থেকে ২১শে ফেব্রুয়ারি বিশ্বের ১৮৮টি দেশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন শুরু হয়। এখন বাংলাকে রাষ্ট্রপুঞ্জের দাপ্তরিক ভাষা করার প্রচেষ্টা চলছে।

SHARE

Related posts

Durga Puja 2023

Admin@sangba

“ওরে গৃহবাসী খোল্‌, দ্বার খোল্‌, লাগল যে দোল”। রঙের উৎসব কী ?

Admin@sangba

দুর্গা প্রতিমা তৈরিতে কেন পতিতালয়ের মাটি ব্যবহার করা হয়?

Admin@sangba

Leave a Comment

হোম
ট্রেন্ডিং
ভিডিও
ই-পেপার
যোগাযোগ