
মুস্তাক আহমেদ :
একজন স্বপ্ন দ্বারা আদেশ পেলেন প্রিয় পুত্রসন্তানকে কুরবানী করার । আর একজনকে ওহী নাযিল করে জানিয়ে দিলেন কুরবানী কুরুন । যিনি স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করলেন তিনি। হলে ‘খলিল’ । আর যিনি ওহী (অর্থাৎ কুরআন) বাস্তবায়িত করলেন তিনি হলেন হাবিব।
খলিল বৃদ্ধ বয়সে পুত্র সন্তান পেলেন, আর হাবীব পরপর তিন পুত্র হারিয়ে ‘কাওসার’ অর্থাৎ মা ফাতেমাকে পেলেন। খলিলকে বলা হল, ‘আমি তাকে ধৈর্য্যশীল পুত্রের সুসংবাদ দান করলাম । অতঃপর সে যখন তার পিতার সাথে শ্রম দেওয়ার উপযুক্ত হল তখন সে, (খলিল) বলল হে বৎস! নিশ্চয় আমি স্বপ্ন দেখেছি যে, তোমাকে আমি জবেহ করছি’- (সুরা সাফফাত-১০১-১০২) আর হাবীবকে বলা হল, ‘নিশ্চয়ই আমি তোমাকে কাউসার (অত্যাধিক কল্যাণ) দান করেছি, সুতরাং তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর আর কুরবানী কর। নিশ্চয়ই তোমার শত্রুরা নির্বংশ।’ (সুরা কাউসার) খলিল পুত্র সন্তান কুরবানী করলেন নির্জন মরুভূমি, চোখে পটি বেঁধে পরীক্ষায় উত্তির্ণ হওয়ার বাসনায় । আর হাবীব কুরবানী দিলেন কারবালায় পুত্র হুসাইন সহ ১৬জন আত্মীয়কে দ্বীন রক্ষার জন্য । খলিলের কুরবানী হল ইসমাঈল (আঃ)। আর হাবীবের কুরবানী হল ইমাম হুসাইন (আঃ), যিনি ছিলেন কাউসারের গর্ভজাত ও কুরআনের ভাষায় মুহাম্মদের সন্তান (সূরা আলে ইমরান ৬১) । তাঁর সন্তানদের ব্যাপারে হাবীব বলেছেন, এ বালক ও তাঁর ভাই দুনিয়ায় আমার দুটি সুগন্ধি ফুল। (সহি বুখারী, তিরমিযি, খ-২, পৃ-৩০৬, মসনদে আহমদ, খ-২, ও আবুদাউদ খ-৮) তিনি আরো বলেছেন হুসাইন আমার হতে আমি হুসাইনহতে। (সহীহ তিরমিযি খ-২, পৃ-৩০৬, মুসনদে আহমদ খ-৩) ইমাম হুসাইন (আঃ) ও তাঁর নিজের পরিচয় শাহাদতের পূর্ব মুহুর্তে একটি বাক্যের মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন । তিনি বলেছেন, “হে আল্লাহ তুমি জান যে, এর পর জমিনের বুকে তোমার নবী দুহিতার কোন পুত্রই আর রইল না।’খলিল ও হাবীব এদু’টির বাংলা অর্থ-বন্ধু । কিন্তু আল্লাহর দৃষ্টিতে খলিল ও হাবীব এদুটি শব্দের তাৎপর্য বহু ফারাক। সর্বজন স্বীকৃত যে, হাবীব হলেন আম্বিয়াদের সদ্দার । সেক্ষেত্রে খলিলেরও সর্দ্দার । তাই আমরা দেখবো খলিল ও হাবীবের ব্যাপারে আল্লাহ কি বলেছেন এবং তাঁদের মর্যাদার ফারাক কতটা। সৃষ্টি রহস্য অবগত হওয়ার জন্য খলিল আল্লাহকে বলেছিলেন, ‘হে আমার রব ! আপনি মৃতকে কিভাবে জীবন্ত করেন তা আমাকে দেখান । আল্লাহ বলেন তুমি কি আমার প্রতি বিশ্বাস রাখ না? খলিল বললেন, ‘হে আমার আল্লাহ আমি ঈমান রাখি সচক্ষে দেখার উদ্দেশ্যে মানুসিক প্রশান্তি লাভ করার জন্য দেখতে চায়।’কিন্তু সৃষ্টি রহস্য দেখানোর জন্য খোদ আল্লাহপাক তাঁর ঘুমন্ত হাবীবকে বিছানা থেকে তুলে নিয়ে যান। পাক কুরআনে উল্লেখ আছে, “আমি স্বীয় বান্দাকে (হাবীবকে) রাত্রিকালে সম্মানিত (কাবা হতে) মসজিদে আকসা অবধি পরিভ্রমন করিয়ে ছিলাম, যাতে আমি তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখাই । – (সুরা বনি ইসরাঈল -১) অর্থাৎ হাবীবকে তিনি স্বয়ং রাত্রিকালে সৃষ্টি রহস্য দেখাবার জন্য তুলে নিয়ে গিয়ে সপ্তম আসমান অতিক্রম করে সিদরাতুল মুনতাহা পার করে সত্তর হাজার নূরের পড়দা ভেদ করে নিজের দিদার দেন পবিত্র মিরাজে আর খলিল সৃষ্টি রহস্য দেখার জন্য আবেদন
করেছিলেন আর আল্লাহ সৃষ্টি রহস্য দেখানোর জন্য হাবীবকে নিয়ে গেছেন তাঁর অতি নিকটে যেখানে ফেরেশতার ও যাবার অধিকার নেই। খলিল আল্লাহকে পাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন, আর আল্লাহ হাবীবকে নিজের কাছে নিয়ে গেছেন তাঁর এমন নিকটে যেখানে দুটি ধনুকের সমপরিমান আধ্যাত্মিক ফাঁক ছিল। খলিল বা তার পরিবার পরীক্ষা দিতে গিয়ে যে কর্ম প্রচেষ্টা চালিয়েছেন তা হল খলিলের সুন্নাত, আজকের হজ ব্যবস্থা ও পশু কুরবানী খলিলের স্মরণে উম্মত পালন করে থাকেন। হজে গিয়ে সেই সব কর্ম বাস্তবায়ন করেন যেগুলি খলিল ও তাঁর পরিবার পরীক্ষা দিয়েছিলেন। সাফা মারওয়া, মিনায় পাথর ছোঁড়া, মাথা মুন্ডন করা, কাবা প্রদক্ষিণ করা, খলিলের পায়ের ছাপ মাকামে ইব্রাহিমের নিকট নামাজ আদায় করা ইত্যাদি বহু রীতিনীতি, তাই তারা এর নাম করণ হয়েছে মিল্লাতে ইব্রাহীম। এদিকে হাবীব ও তাঁর পরিবার দ্বীন ইসলামকে শয়তান মুয়াবিয়া ও তার কুপুত্র ইয়াজিদের শয়তানী থেকে রক্ষা করার জন্য যে কুরবানী দিয়েছিলেন এবং অশেষ আত্মত্যাগ করেছিলেন ইসলামকে বাঁচার তাগিদে সেই আত্মত্যাগের স্মরণে যখন তাঁর অনুসারীরা মাতম বা মার্সিয়া ও নোহাখা করে কারবালার শহীদের স্বরণ করে তখন সেটাকে বেদাত বলা হয় । ইমাম হুসাইনের রওযা মুবারক জিয়ারত করতে যাওয়াকে হারাম বলে ফতোয়া দেয় – যে গুলি সবই হাবীবের কুরবানীর নমুনা বা আকবর সুন্নাত ।হাবীবের কুরবানীকে জীবন্ত রাখার জন্য মাতম বা মার্সিয়া পাঠ হলে তারা চিৎকার করে বলে, ‘ত্যাগ চাই মার্সিয়া ক্রন্দন চাই না ৷” ‘মিল্লাতে ইব্রাহীমের’ নামে যারা খলিলের সুন্নাতকে দাবাতে চায় তারা যে চরম বিভ্রান্ত তার প্রমাণ তারা মিল্লাতের সদস্যদের ধর্মের যুযুদেখিয়ে শোষণ করে। আর জুলুমের (আমেরিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে গণদেবতা হতে চায়) আমেরিকার সঙ্গে হাত মেলায়। জুলুম (আমেরিকা) তাদের সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে তাদেরই গৃহহীন ও খাদ্যহীন করে ছাড়ে। এক সময় তারা লজ্জা ও ভয়ে গৃহবন্দী জীবনে প্রলাপের জারিগান গাইতে থাকে । আর যারা হাবীব ও তাঁর পরিবারের কুরবানীর শিক্ষা নিয়ে মাতম, মার্সিয়া ও ইমাম হুসাইনের কবর জিয়ারত জারি রাখে তারা জুলুমের (আমেরিকা) বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কন্ঠ,অন্যায়ের উৎসকে নির্মূল ইত্যাদি সর্ব প্রকার চেষ্টা চালায়, তারা ত্যাগী হয়ে দুর্বলদের সাহায্যের জন্য হস্ত প্রসারিত করে। যারা মার্সিয়া ক্রন্দন করে হাবীবের উম্মতের ভাবনাকে জাগ্রত করে তারা জালেমের বুকে ত্রাস সৃষ্টি করতে চাই এবং তাদের ত্যাগ, মার্সিয়া ও ক্রন্দন এতটা শক্তিশালী হয় তার কারণ তারা খলিলের কুরবানী সঙ্গে সঙ্গে হাবীবের কুরবানীর বাস্তবতাও চালু রাখে আর তাদের ক্রন্দনকে বা মার্সিয়াকে বা জিয়ারতকে যারা ঘৃণা করে তারা মিল্লাতে ইব্রাহীমের নামে কিতাবী ঢং দেখায় তারা গ্রন্থ পূজারী তারা পৃষ্ঠপ্রদর্শন কারী, তারা পিছুটান মনবৃত্তিতে মানসিক ভাবে দুর্বল ও ভীরু । এই ভীরুতা তাদের হৃদয়ে সৃষ্টি হয় লোভ ও হিংসা। আর এই হিংসার পালনকারীরা মিল্লাতে ইব্রাহিমের নামে পরস্পর বিচ্ছিন্নতার শিকারে একে অপরের বিরুদ্ধে অস্ত্র প্রয়োগ করে অন্যান্যকে সমর্থন করতে এতোটুকু লজ্জা বোধ হয়না। যারা হাবীবের কুরবানীকে পরিত্যাগ করেছে তারা হাবীবকে পরিত্যাগ করেছে। অথচ হাবীব একদিন শিশু হুসাইনের ঠোটে এবং গলায় চুম্বন দিতে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে ছিলেন। ‘আমি তলোয়ারের জায়গায় চুম্বন করছি’ (লুক সাইয়েদ ইবনে তাউস, পৃ-৩৫, তাজকিরা পৃ- ২৫০ ) মহরম ও আশুরার দিন ইমাম হুসাইনের মুর্শিবত স্মরণ করে হাবীবের কুরবানীর বাস্তবতা ফিরিয়ে আনা দরকার শোকপালন ও আযাদারী পালন করে। তাই ইমাম হুসাইন বলতে চেয়েছেন, আমি অত্তরার শহীদ। আমি নিহত হয়েছি কষ্ট স্বীকার করে তাই কোন মুমিন আমাকে স্মরণ করলে জিকির না করে পারে না। খলিলের থেকে হাবীব শ্রেষ্ঠ। উম্মতের উচিত খলিলের সুন্নাত সহ হাবীবের সুন্নত জীবন্ত করা এবং সামনের দিয়ে এগিয়ে যাওয়া। পৃষ্ঠপ্রদর্শন করা উচিত নয় । যখন যুদ্ধে মুনাফেরা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেছিল । রসুল ওফাত নেবার পর গাদি দখল ও সকীফা হলের তীব্র আকর্ষণে মৃত হাবীব থেকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করার রীতি এখনও জারি রয়েছে। তাই আল্লাহপাক আল কুরআনে সতর্কবার্তা হিবাবে বলেছেন, ‘মুহাম্মাদ (দঃ) একজন রসুল মাত্র, তাহার মতো বহু রসুল গত হইয়াছে সুতরাং যদি যে মারা যায়, অথবা নিহত হয় তবে তোমরা কি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে। এবং কেউ পৃষ্ঠপ্রদর্শন করিলে সে কখনো আল্লাহর ক্ষতি করবে না । আল্লাহ শীঘ্রই কৃতজ্ঞদিগকে পুরস্কৃত করবেন।
(সুরা ইমরান-১৪৪) রসুল তার আহলে বাইতের মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করে গেছেন এবং তাদের মেনে চলার, বা দ্বীন ইসলমাকে তাদের নিকট হতে গ্রহণ করার এবং তাদের প্রতি মহব্বত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন কিন্তু প্রতারক মুসলমান রসুলের ওফাতের পরেই পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে ফাঁকিবাজী মতলভ দেখিয়ে মিল্লাতে ইব্রাহীমের নামে মুসলিম জাতীয়তাবাদী স্বধর্মে যেতে চাইছে- যা দ্বীন থেকে খারিজ হওয়ার লক্ষণ কারণ রসুল বলেছেন, ‘জেন রাখ নিশ্চয়ই আমার আহলে বাইত তোমাদের জন্য নূহের তরণীর মতো । যে ব্যক্তি তাতে আরোহণ করবে সে মুক্তি পাবে । যে তা থেকে বিরত থাকবে সে নিমজ্জিত হবে। (হাকিম নিশাবুরী তার মুস্ততাদরাকের খ-৩, পৃ-১৫১ দেখুন) আল কুরআন বলছে, ‘রসুল (হাবীব) তোমাদের যাহা দেয় তাহা গ্রহণ কর এবং যাহা হতে তোমাদের নিষেধ করে তাহা হইতে তোমরা বিরত থাক এবং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর । ‘(সূরা হাশর ৫৯) হাবীব যা দেয় তা গ্রহণ করাতো দুরের কথা হযরত আলী এর খিলাফত অস্বীকার করে হাবীবের জানাজা ও দাফন কর্মে উপেক্ষা করেছিলন । তারাই আজ হাবীবের কুরবানীর স্মরণ-আলম, শোকপালন, মাতম ও আজাদারীকে ঘৃণা করে এবং তারা এখনো ধর্মের নামে সর্বদা হারাম ভক্ষণ করে। কারণ তারা হাবীবের দেওয়া উপহার কন্যা ফাতেমার নিকট হইতে বাগে ফেদাক হরণ করেছিল।(হাওড়া থেকে সত্যের পথের সম্পাদক -মুস্তাক আহমেদ এর নিজস্ব প্রতিবেদক)।